গৌতম বুদ্ধের জীবনী || gautam buddha biography in bengali
বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধ কেবল মাত্র যে একজন ধর্ম প্রচারক ছিলেন টা নয়, তিনি একজন মহান দার্শনিক ছিলেন। বহুবিধ ঐতিহাসিক গবেষণা ও পর্যালোচনা এর মাধ্যমে আমরা তার জীবন সম্পর্কে নানান তথ্য সূত্র লাভ করেছি। বুদ্ধদেব জানিয়েছেন, কিভাবে মানুষ তার জীবনে শান্তি পেতে পারে। এই শান্তির জন্য দরকার অহিংসা, সত্যবাদিত, মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং সাম্যবোধ। আজো এই পৃথিবীতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও অনুরাগীর সংখ্যা অসংখ্য আমরা ভাগ্যবান যে গৌতম বুদ্ধ আমাদের এই দেশ ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেন।
যিশুখ্রিস্টের জন্মের ৫৬৩ বছর আগে নেপালের নিকটবর্তী কপিলাবস্তু তে গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব ঘটে। পার পিতা ছিলেন কপিলাবস্তুর নৃপতি সুদ্ধোধন এবং মাতা মায়াদেবী। বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে তাঁর জন্ম।
বাল্যকালে তার নাম ছিল সিদ্ধার্থ। খুব কম বয়সেই তিনি তার মাতা মায়াদেবী কে হারান। তার বিমাতা মহাপ্রঞ্জাবতি গৌতমী তাঁর লালন-পালনে এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাই সিদ্ধার্থের অপর নাম গৌতম। আবার তিনি শাক্য বংশের সন্তান ছিলেন বলে তাকে বলা হয় শাক্যমুনি।
যৌবনে তিনি বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করেন। তার স্ত্রীর নাম যশোধারা। যশোধারা কে গোপা নামেও অভিহিত করা হতো।
ছেলেবেলা থেকেই গৌতম ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির। সর্বক্ষণই মানুষের দুঃখ ও বেদনার ভাবনা তে আত্মমগ্ন। পরম পুরুষের নিকট তার একটাই নিবেদন – মানুষ কিভাবে এই দুঃখ, বেদন , গ্লানি ও হতাশা থেকে মুক্তি পাবে তার উপায় কে জানাতে হবে।
এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখা দরকার যে, গৌতম বুদ্ধ প্রবর্তিত ধর্মের মর্মকথা আমাদের দেশের সভ্যতা ও ধর্মবোধে প্রাচীন কাল থেকেই উপস্থিত ছিল। বুদ্ধদেব তার নব সংহত রুপ প্রদান করেন। বৌদ্ধ ধর্মগুরুরা বলেছেন ভগবান বুদ্ধ এর আগে আরো পঞ্ছান্নবার এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। গৌতম বুদ্ধ হলেন তার শেষ আবির্ভাব। প্রতিবারই তিনি মানুষের কল্যাণ করে গেছেন উৎসাহ ও উপদেশ ও আশীর্বাদ এর মাধ্যমে। ললিত বিস্তার গ্রন্থে আদি বুদ্ধদেবের নাম আমরা পেয়েছি।
এরা হলেন পদ্দত্তোর, ধারমোকেতু, দীপঙ্কর, গুনকেতু, মহাকর, হৃষীকর, ঋষিদেব, শ্রীতেজা, সাত্যকেতু, বজ্রসংহত, সর্বাবিভু, হেমবর্ন, অত্যুচ্চগামী, প্রবাতসার, পুস্পকেতু, বররূপ, সুলোচন, ঋষিগুপ্ত, জিনবত্ত, উন্নত, পুষিপত, ঊরনীতেজা, পুষ্কর, ইরশ্মি, মাঙ্গল, সুদর্শন, সিংহতেজা, স্থিবুদ্ধিদত্ত, বসন্তগন্ধি, বিপুলকীর্তি, পুষ্য, তিষ্য, লোসুন্দর, বিস্তরনভেদ, রত্নকীর্তি, উগ্রত্তেজা, ব্রম্মতেজা, সঘোষ, সুপুশ্য, সুমনোজ্ঞ, সুতেস্ট, প্রহতিনেত্র, গুনরাশি, মেঘস্বর, সুররন, আয়ুস্তেজা, সুনীলগাজগামী, জিতশত্রু, লকাভিলাশি, শিখি, বিশ্বম্ভু, কেনকমুনি, কাশ্যপ, বিপশ্চিৎ, সম্পুজিত, ক্রুকচ্ছেদ ইত্যাদি।
যাই হোক, সংসারের প্রতি গৌতম এর অনাগ্রহ দেখে ১৮ বছর বয়সে তাকে যশোধারা নামে এক সুন্দরী রাজকন্যার সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয়। কিন্তু তবুও সংসার জীবনে সিদ্ধার্ত প্রাণবন্ত হয়ে উঠলেন না। মানুষের জরা-ব্যাধি ও মৃত্যু তাকে সর্বক্ষণ ভাবিত করে রাখত। পরিশেষে তার স্ত্রী যশোধারা এর গর্ভে রহুল নামে এক পুত্র সন্তান জন্ম হওয়ায় সিদ্ধার্থ ভয় পেয়ে গেলেন – সংসারের মায়াএ বুঝি তিনি আবদ্ধ হয়ে পড়বেন। তাই সেই বন্ধন ছিন্ন করে সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করলেন।
প্রথমে তিনি উপস্থিত হলেন বিহারে। সেখান থেকে উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিভ্রমন করেন। অনেক সাধু ও সন্ন্যাসীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে। বড় বড় সাধুদের অনন্য সাধনার প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন দুজন নামী সাধকের নিকট, তারা হলেন আড়ার কলাম ও রুদ্রক। তারপর তিনি চলে যান গয়া তে । সেখানে এক বোধিবৃক্ষের তলায় বসে শুরু হলো তার দীর্ঘ তপস্যা। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সাধনায় সিদ্ধিলাভ না করে তিনি সেই বৃক্ষ ত্যাগ করবেন না। অনেক শারীরিক বাধা-বিপত্তি ও বিরম্বনা সত্বেও তিনি সিদ্ধিলাভ করলেন। তখন তার নাম হলো বুদ্ধ। সিদ্ধিলাভ এর এই দিনটি ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা। বুদ্ধদেবের বয়স তখন ৩৫ বছর।
সিদ্ধি লাভের পর গৌতম বুদ্ধ ধর্ম প্রচারে প্রথমে উপস্থিত হন ঋষিপত্তমে। এই ঋষিপত্তম বর্তমানে সারনাথ নামে পরিচিত। এখানে তিনি তার পূর্বপরিচিত পাঁচ জন সংসার ত্যাগী কে দিক্ষা দেন। সেই পাঁচজন সন্ন্যাসীর নাম কৌ িড্রন্য, অশ্বজিত, বপ্র, ভদ্দিয়া ও মহানাম। এই ঘটনা বৌদ্ধ সমাজে ধর্মচক্র নামে পরিচিত। বুদ্ধদেব তাদের চারটি মহাসত্যের কথা বলেছিলেন। সেগুলি এই প্রকারঃ
প্রথম সত্য – মানুষের সাংসারিক জীবনে দুঃখ হলো মজ্জাগত। একটি দুঃখের পর আরেকটি আসে, তারপর আরেকটি অর্থাৎ ও বিড়ম্বনা সকল সময়ে সাম্প্রতিক।
দ্বিতীয় সত্য – মানুষের দুঃখ ও বিরম্বনার মূল কারণ হলো বিষয় সম্পত্তির উপর লোভ, মানুষের অন্তরে প্রলোভনের এই বিষদাঁত ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
তৃতীয় সত্য – ওই বিষদাঁত কে সমূলে উৎপাটন করার দায়িত্ব মানুষের নিজেরই।
চতুর্থ সত্য – মানুষের মুখ্য লক্ষ্য হওয়া উচিত নির্বাণ লাভ নির্বাণ লাভ। নির্বাণ লাভ কিভাবে সম্ভব, বুদ্ধদেব তার জন্য পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। এই আটটি উপায় অবলম্বন করলে একজন মানুষের পক্ষে মুক্তিলাভ সম্ভব।
- সম্যক দৃষ্টি – চার প্রকার সত্য ও সতিত্য সমুতপাদ বিষয়ে ঠিক ঠিক অয়াকিবহল থাকা।
- সম্যক সংকল্প – নিষ্কাম সখ্যতা ও করুনা সিক্ত হৃদয়কে অর্জন করা।
- সম্যক বাক্য – সততা ও প্রিয় তার সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ বাক্য ব্যবহার।
- সম্যক কর্ম – জীবে দয়া প্রদর্শন, আচরণে বদান্যতা বজায় রাখা এবং চরিত্রকে নিষ্কলুষ রাখা।
- সম্যক জীবিকা – সততার সঙ্গে কর্ম সম্পাদন করে জীবিকা নির্বাহ।
- সম্যক উদ্দম – সর্বক্ষণ সুচিন্তা করা।
- সম্যক স্থিতি – অন্য কে ঈর্ষা না করা, পর নিন্দা পরচর্চা রত না থাকা।
- সম্যক সমাধি – কাম প্রভাবকে দূর করে চিন্তাকে সুভাবনায় আকাগ্র রাখা।
বুদ্ধদেব ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছু বলেননি। তিনি মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে ছিলেন। ফলে হিন্দু ব্রাহ্মন্যবাদের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের বিরোধ ছিল অনিবার্য। বুদ্ধদেব বলতেন, যার জন্ম হয়েছে ক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে তার বিনাশ অনস্বীকার্য। এই সময় মধ্যে যিনি সত্য ধর্ম পালন করতে পারেন, তবে তাকে আর এই বিষাদ পূর্ণ পৃথিবীতে ফিরে আসতে হবে না।
বুদ্ধদেব তার জীবনে ব্যাপক পরিভ্রমন করেছেন এবং ধর্ম প্রচার করেছেন। তিনি কোথাও এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে না। কেবলমাত্র বর্ষা ঋতুতে কোন একটি স্থানে একটানা চার মাস অবস্থান করত। বহু বিপন্ন বাক্তিকে তিনি মুক্তির পথ দেখান,
বহু চঞ্চল মন কে তিনি প্রশান্ত করেন।
রাজা বিম্বিসার বুদ্ধদেবের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন। বুদ্ধদেব কপিলাবস্তু তে গমন করলে তার পুত্র রাহুল, পত্নি, ভ্রিত্ত ও নাপিত তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ৮০ বছর বয়সে তিনি পায়ে হেটে যাচ্ছিলেন বৈশালী থেকে কুশিনগর। পথে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সে হত্যা করেন। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০ অব্দ তে বুদ্ধদেবের দেহ ত্যাগ করেছিলেন।
মল্লগন বুদ্ধাদেবের দেহ দাহ করেছিলেন। বৌদ্ধারা তার দেহাবশেষ সংগ্রহ করে দশ জায়গায় দশ টি স্তুপ নির্মাণ করেন এবং স্তুপগুলির অভ্যন্তরে সেই দেহাবশেষ সংরক্ষণের চেষ্টা করেছিলেন।